ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল হলেন আধুনিক নার্সিং সেবার অগ্রদূত৷ তিনি একাধারে একজন লেখক এবং পরিসংখ্যানবিদও। তিনিই আবার ‘দ্যা লেডি ইউথ দ্যা ল্যাম্প’ নামেও পরিচিত। ১৯৭৪ সাল থেকে এই নারীর জন্মদিন ১২ মে পালিত হয়ে আসছে ‘ইন্টারন্যাশনাল নার্সেস ডে’। যার মাধ্যমে সম্মান জানানো হয় এমন এক নারীকে যিনি তাঁর কর্মের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করেছেন- নার্সিং একটি পেশা নয় সেবামাত্র। তাঁর জীবদ্দশায় ইউরোপে ব্রিটেন, রাশিয়া ও ফ্রান্সের মধ্যে এক যুদ্ধ ভয়ানক যুদ্ধ হয়, যা ক্রিমিয়া ওয়ার বা ক্রিমিয়ার যুদ্ধ নামে পরিচিত৷ ওই যুদ্ধ চলেছিল দুই বছর ধরে। এই নারী সেই সময় ৩৮ জন সেবিকাসহ দুবছর ধরে যুদ্ধক্ষেত্রে আহতদের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। ক্রমে ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল আধুনিক নার্সিংয়ের পথপ্রদর্শক বনে যান।
১৮২০ সালের ১২ মে এক অভিজাত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল। তাঁর বাবা উইলিয়াম এডওয়ার্ড নাইটিঙ্গেল এবং মা ফ্রান্সিস নাইটিঙ্গেল৷
ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল যখন জন্মগ্রহণ করেন তখন অনেক মেয়েই শিক্ষা কী তা ঠিক বুঝত না। সেক্ষেত্রে ফ্লোরেন্সের ভাগ্য ভাল ছিল কারণ তাঁর বাবা উইলিয়াম বিশ্বাস করতেন, মেয়েদেরও শিক্ষাগ্রহণ করা উচিত। তিনি ফ্লোরেন্স ও তার বোনকে নানা বিষয়ে শিক্ষা দিয়েছিলেন। তাদের বিজ্ঞান, গণিত, ইতিহাস ও দর্শন পড়ান হয়েছিল।
অবশ্য ছোটবেলা থেকেই কেউ অসুস্থ হলে ফ্লোরেন্স ছুটে যেতেন সেখানে সেবা করতে। ১৭ বছর বয়সে তিনি ডার্বিশায়ার থেকে লন্ডনে আসেন। সে সময় লন্ডনের হাসপাতালগুলোর অবস্থা ছিল খুবই করুণ। এর অন্যতম কারণ সে সময়ে কেউ সেবিকার কাজে এগিয়ে আসতেন না। এ পেশাকে তখন খুব ছোট করে দেখা হতো। অথচ তিনি জীবনের সেরা এমনকি সবটুকু সময় ব্যয় করেছেন মানুষের সেবায়। প্রবল তুষারপাত ও বৃষ্টির মধ্যেও তিনি হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ঘুরে বেড়িয়েছেন। মাত্র ১৭ বছর বয়সেই নাইটিঙ্গেল উপলব্ধি করছিলেন স্রষ্টা তাঁকে সেবিকা হওয়ার জন্যই পাঠিয়েছেন। এ কাজে আগ্রহ প্রকাশ করলে প্রথমে তাঁর মা-বাবা রাজি হননি এই ভেবে, একজন শিক্ষিত মেয়ে হিসেবে তার অন্য কোনও ভালো পেশায় যাওয়া উচিত। কিন্তু আশা ছাড়েননি ফ্লোরেন্স। অবশেষে বাবা-মায়ের অনুমতি নিয়ে তিনি ১৮৫১ সালে নার্সের প্রশিক্ষণ নিতে পাড়ি দেন জার্মানিতে। এরপর ১৮৫৫ সালে তিনি নার্স প্রশিক্ষণের জন্য তহবিল সংগ্রহের কাজ শুরু করেন। তাঁর এই নিরলস প্রচেষ্টার জেরে ১৮৫৯ সালে তিনি প্রায় ৪৫ হাজার পাউন্ড সংগ্রহ করে ফেলেন নাইটিঙ্গেল ফান্ডের জন্য।
পরবর্তী সময়ে তিনি ভারতবর্ষের গ্রামীণ মানুষের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর গবেষণা চালান। যা ভারতবর্ষে উন্নত স্বাস্থ্যসেবা পৌছে দেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। আবার ইংল্যান্ডের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়নেও তিনি বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। ১৮৫৯ সালে তিনি ‘রয়্যাল স্ট্যাটিসটিক্যাল সোসাইটির’ প্রথম সারির সদস্য নির্বাচিত হন। লন্ডনের সেন্ট থমাস হাসপাতালে নার্সিংকে সম্পূর্ণ পেশারূপে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ১৮৬০ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘নাইটিঙ্গেল ট্রেনিং স্কুল’ যার বর্তমান নাম ‘ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল স্কুল অব নার্সিং । ডা. এলিজাবেথ ব্ল্যাকওয়েলের সাথে যৌথভাবে ১৮৬৭ সালে নিউইয়র্কে চালু করেন ‘উইমেন্স মেডিক্যাল কলেজ’। এ ছাড়াও তিনি বিভিন্ন সময় নার্সিংয়ের উপর বেশ কিছু বইও লেখেন।তিনি অসংখ্য পদক আর উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন। ১৮৮৩ সালে রাণী ভিক্টোরিয়া তাকে ‘রয়েল রেডক্রস’ পদক প্রদান করেন। প্রথম নারী হিসাবে ‘অর্ডার অব মেরিট’ খেতাব লাভ করেন ১৯০৭ সালে। ১৯০৮ সালে লাভ করেন লন্ডন নগরীর ‘অনারারি ফ্রিডম’ উপাধি।
১৯১০ সালের ১৩ আগস্ট ৯০ বছর বয়সে লন্ডনে নিজ বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেন যাত্রী ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল। কিন্তু তাঁর কর্মজীবনের স্বীকৃতি স্বরূপ ইস্তাম্বুলে চারটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা হয় তাঁর নামে। লন্ডনের ওয়াটারলু ও ডার্বিতে রয়েছে এই সেবিকার প্রতিকৃতি। লন্ডনের সেন্ট থোমাস হসপিটালে রয়েছে ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল মিউজিয়াম।তাছাড়া ব্রিটিশ লাইব্রেরি সাউন্ড আর্কাইভে সংরক্ষিত রয়েছে তার কণ্ঠস্বর, যেখানে তিনি বলেছেন- যখন আমি থাকব না, সেই সময় আমার এই কণ্ঠস্বর আমার মহান কীর্তিগুলোকে মানুষের কাছে মনে করিয়ে দেবে এবং এসব কাজের জন্য উৎসাহ জোগাবে। তাঁকে নিয়ে ‘দ্য লেডি উইথ দ্য ল্যাম্প’ নামে একটি নাটক মঞ্চায়িত হয় ১৯২৯ সালে- যার নামভূমিকায় অভিনয় করেন এডিথ ইভানস। এছাড়া তার জীবনকে ভিত্তি করে চারটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয় বিভিন্ন সময়ে।
Recent Comments